সাকা সমাচার : মৃত্যুদন্ড বহাল সাকা চৌধুরীর


মু21_ganajagaran+Manch_protest_250715_0003 02_Salauddin+Quader+Chowdhury_300913

ক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ।

বুধবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৪ সদস্যের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন: বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

এ বেঞ্চের আজকের কার্যতালিকার ১ নম্বরে এ মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য রাখা ছিল।

একাত্তরে চট্টগ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা থেকে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে হত্যা ও নির্যাতনের অন্যতম হোতা ছিলেন সাকা চৌধুরী।

মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৩টি অভিযোগের ৯টি অপরাধের ঘটনাই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

যেসব অভিযোগে সাকার ফাঁসি বহাল

গুডস্ হিল নামে পরিচিত এ বাড়িটি ১৯৭১ এ ছিল মুক্তিকামী বাঙালির জন্য আতংকের নাম। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা বিশেষ করে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা থেকে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন করা হতো এখানে। বাড়িটি পৈত্রিক সূত্রে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর।

কোনো দল বা সহযোগী সংগঠনের হয়ে নয়, একাই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছেন সাকা চৌধুরী। মেতে উঠেছিলেন হত্যার হোলিখেলায়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৩টি অভিযোগের ৯টিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে ও খালাস চেয়ে ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর আপিল করেন সাকা চৌধুরী।

৪টি অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেনি। চলতি বছরের ১৬ জুন আপিলের শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ৭ জুলাই। ওই দিন আদালত রায় ঘোষণার জন্য ২৯ জুলাই (আজ) তারিখ ধার্য করেন।

অভিযোগ গুলো হলো:

১. কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যা,

২. সুলতানপুরের নেপাল চন্দ্র ও আরো ৩ জনকে হত্যা,

৩. উনসত্তরপাড়ায় ৭০ জনকে হত্যা,

৪. চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর হোসেন ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে নির্যাতন ও হত্যা।

রায়ে বলা হয়, সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২৩টি অভিযোগ এনেছে, যার মধ্যে ৯টি (২ থেকে ৮ এবং ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগ) প্রমাণিত হয়েছে।

এর মধ্যে ৩য় অভিযোগে নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, ৫ম অভিযোগে সুলতানপুর বণিকপাড়া ও ৬ষ্ঠ অভিযোগে ঊনসত্তরপাড়ায় গণহত্যা, ৮ম অভিযোগে হাটহাজারীর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মোজাফফর ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের দায়ে সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়।

২য়, ৪র্থ ও ৭ম অভিযোগে হত্যা, গণহত্যার পরিকল্পনা, সহযোগিতা এবং লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও দেশান্তরে বাধ্য করার ঘটনায় সাকা চৌধুরীর সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ২০ বছর করে ৬০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়।

১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে অপহরণ ও নির্যাতনের দায়ে তাকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। বাকি ১৪টি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সেগুলো থেকে তাকে খালাস দেয় ট্রাইব্যুনাল।

উল্লেখ্য, হরতালে গাড়ি পোড়ানোর এক মামলায় ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

২০১২ সালের ৪ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল।

সাকার বাঁকা স্বভাবে ছিলো কাঠগড়াতেও

উদ্ধত আচরণ ও অশালীন কথার জন্য বরাবরই আলোচিত নিন্দিত সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আসামীর কাঠগড়ায় দাড়িয়েও নিজের বাঁকা স্বভাবের পরিচয় দিয়েছেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত মানবতা বিরোধী এ অপরাধী বিচারিক কার্যক্রমের সময় উদ্ধত্বপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে বাধাসৃষ্টি করেছেন বারবার।

কাঠগড়ায় দাড়িয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনকর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছেন। এমনকি ট্রাইব্যুনালের রায়ের দিনও বিচারককের সঙ্গে উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, প্রসিকিউটরদের হুমকি, বিচারকাজ, সাক্ষী ও চলমান রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করাসহ এজলাসে বহু বিতর্ক সৃষ্টি করেন কুখ্যাত সাকা চৌধুরী।

বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম দিকে ২০১১ সালে ট্রাইব্যুনালের বিচারককে হুমকি দিয়ে সাকা চৌধুরী বলেছিলেন, চোখ রাঙাবেন না।

আবার ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানকে আইন শেখাতে আসবেন না বলে ধমক দেন বিএনপির এই স্থায়ী কমিটির সদস্য। আর এটর্নি জেনারেলকে এজলাস কক্ষে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলেন তাকে দুই বছর জেলে রাখা হয়েছে বের হলে তিনি দেখে নিবেন। সেই সঙ্গে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করেন।

২০১৩ সালের ১৭ জুন নিজের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেয়ার আগে আইন অনুযায়ী শপথ নিতেও অস্বীকার করেন তিনি।

এ সময় ট্রাইব্যুনালকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, তাকে ফাঁসিতো দেয়া হবেই তাই তিনি কিছুই পরোয়া করেন না। বিভিন্ন সময় প্রসিকিউটরদের হেয় করে কথা বলেছেন। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটদের একদিন ফাসিতে ঝুলতে হতে পারে বলে পরোক্ষ হুমকি দিয়েছেন।

৯ দিনের সাফাই সাক্ষের পুরোটাই ইংরেজিতে দেন সাকা চৌধুরী। এর স্বপক্ষে নিজেকে বাঙালি নয় চাটগাঁইয়া বলে দাবি করেন তিনি।

বাংলা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজেকে তিনি বাঙালি নয় উল্লেখ করে তার মাতৃভাষা চাটগাঁইয়া বলে দাবি করেন। তার সাক্ষ্যে তিনি এও বলেন যে , তিনি পছন্দসূত্রে বাংলাদেশি, জন্মগতভাবে নন।

ট্রাইব্যুনালের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বসে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও বাকবাণ ছুড়ে এজলাসক্ষের পরিবেশও বেশ কয়েকবার উত্তপ্ত করে তোলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। অনেক সময় চিৎকার চেচামেচি করার কারণে তাকে ছাড়াই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বিভিন্ন সময় তার অশালিন আচরনের জন্য সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন, আবার এজলাস কক্ষে হাসির খোরাকও জুগিয়েছেন সাকা চৌধুরী।

কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়েও। সেনাবাহিনী নিয়েও বাজে মন্তব্য করেছেন।

রাজনীতির মাঠে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার স্বভাবসুলভ গোঁয়ার্তুমির কারণে বরাবরই আলোচিত নাম। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ চুড়ান্ত বিচারের মুখোমুখি হয়েও তার স্বভাবে বিন্দুমান্ত্র পরিবর্তন হয়নি বলে মনে করছেন ট্রাইব্যুনাল ও আইনজীবীরা।

শুধু সাকা চৌধুরী নন, বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে তার আইনজীবী ও স্বজনেরাও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে কথা বলেছেন, বাজে মন্তব্য করেছেন।

সাকার রায়কে কেন্দ্র করে সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তা

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর আপিলের রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী সাকা চৌধুরীর আপিলের রায়কে কেন্দ্র করে যে কোনো বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে।

পুলিশ ও র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়েন (র্যা ব) পাশাপাশি ঢাকায় ১০ ও দেশের অন্যান্য স্থানে ৭৭ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে।

এছাড়া, বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার ও কূটনৈতিক এলাকায়।

সাকার মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় শাহবাগে উল্লাস

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড আপিল বিভাগে বহাল থাকায় খবরে উল্লাসে ফেটে পড়ে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে সমবেত জনতা।

বুধবার সকালে রায়ের খবর শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চে পৌঁছার পর পরই সেখানে অপেক্ষায় থাকা সমবেত জনতা বাধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে।

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, এ রায়ে জনগণের প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। এ রায়ের মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্র ও অপশক্তির বিনাশ হয়েছে।

বাংলাদেশে অপরাজনীতি ও বাংলাদেশ বিরোধী যে ষড়যন্ত্র রয়েছে তার মুলোৎপাটনে সহায়তা করবে বলেও জানান গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র।

সাকার মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহালে সন্তোষ প্রকাশ: অ্যাটর্নি জেনারেল

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের আপিল মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

বুধবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৪ সদস্যের বেঞ্চ এ মামলার রায় ঘোষণা করার পর সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মাহবুবে আলম বলেন, সাকা চৌধুরীকে যেসব অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল যে দণ্ড দিয়েছেন, এর মধ্যে ৭ নম্বর ছাড়া বাকি সব সাজা বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।

তিনি বলেন, যে ৪টি চার্জের জন্য সালাউদ্দির কাদের (সাকা) চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে ছিল ট্রাইব্যুনাল সেগুলোসহ বাকি ৪টি চার্জে বিভিন্ন মেয়াদে সাকা চৌধুরীকে দণ্ড দেয়া হয়ে ছিল। সেগুলো সবই সর্বোচ্চ আদালত বহাল রেখেছে।

তিনি আরো বলেন, সাকা চৌধুরী যে যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিলেন, তা প্রমাণ হলো। এ সাজা যদি না হতো, তাহলে প্রচণ্ড হতাশ হতাম। ফাঁসি হওয়ায় প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।

Leave a comment